বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ০৩:৪৬ অপরাহ্ন

ইসরাইল-ভারতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যেভাবে পরমাণু শক্তিধর হয় পাকিস্তান

Reporter Name
  • Update Time : বুধবার, ২ জুলাই, ২০২৫
  • ১ Time View

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : পশ্চিমা বিশ্বের চোখের বালি ছিলেন তিনি। সেটা সাবেক সিআইএ পরিচালক জর্জ টেনেট বা মোসাদের সাবেক প্রধানের কথাতেই পরিষ্কার। টেনেটের চোখে তিনি ছিলেন ‘ওসামা বিন লাদেনের মতোই বিপজ্জনক’, মোসাদের সাবেক প্রধান শাবতাই শাভিত তো আফসোস করেছিলেন, কেন তাকে হত্যা করা হয়নি, এই বলে! পশ্চিমের এমন ক্ষোভের কেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিটি পাকিস্তানের পরমাণু বিজ্ঞানী ড. আব্দুল কাদির খান।

ঘটনার শুরু ১৯৭০’র দশকে। ভারত ১৯৭৪ এর ১৮ মে ‘স্মাইলিং বুদ্ধ’ নামের পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়। যার ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তির ভারসাম্য ভেঙে পড়ে। সীমানার ওপারে পাকিস্তানের ভেতরেও শুরু হয় তীব্র প্রতিক্রিয়া। ভারতের পারমাণবিক পরীক্ষার জবাবে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো তো ঘোষণাই দিয়ে বসেন, যে কোনো মূল্যে পারমাণবিক বোমা তৈরি করবে তার দেশ। বলেন, ‘প্রয়োজনে ঘাস খাব, কিন্তু পরমাণু বোমা বানিয়েই ছাড়ব। খ্রিস্টান, ইহুদি, এখন হিন্দু বোমাও তৈরি হয়ে গেছে, তাহলে মুসলিম বোমা কেন নয়?’

ভুট্টোর এই কর্মসূচিরই নেতৃত্ব নেন একজন বিজ্ঞানী, যার নাম পরবর্তীতে ইতিহাসে চিরকাল খোদাই হয়ে যায়, তিনি ড. আবদুল কাদির খান। ‘প্রয়োজনে ঘাস খাব, কিন্তু পরমাণু বোমা বানিয়েই ছাড়ব। খ্রিস্টান, ইহুদি, এখন হিন্দু বোমাও তৈরি হয়ে গেছে, তাহলে মুসলিম বোমা কেন নয়?’

জুলফিকার আলী ভুট্টো, পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী

আবদুল কাদির খান বা সংক্ষেপে কিউ খান ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশ ভারতের ভোপালে জন্ম নেন। তার পরিবার পরে দেশ ভাগের সময় পাকিস্তানে চলে আসে। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শাখায় পড়াশোনা শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান ইউরোপে। জার্মানির বার্লিনে মেটালার্জি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েন এবং নেদারল্যান্ডসের ডেলফটে ইউরেনকো নামের একটি পারমাণবিক কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন। ইউরেনকোতে কাজ করার সুবাদে বিশ্বসেরা সেন্ট্রিফিউজ প্রযুক্তি তার হাতে আসে, যা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে ব্যবহৃত হয়।

১৯৭৪ সালে ভারতের প্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা ‘স্মাইলিং বুদ্ধ’ চালানোর পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী যখন আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি হাতে নিলেন, তখনই নেদারল্যান্ডসের ইউরেনকোতে থাকা এ কিউ খান পাকিস্তানে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে তিনি হঠাৎ চাকরি ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যান এবং দেশে ফিরে রাওয়ালপিন্ডিতে একটি গোপন গবেষণাগার স্থাপন করেন, যেটি পরে ‘খান রিসার্চ ল্যাবরেটরি’ বা কেআরএল নামে পরিচিত হয়।

‘আমি প্রথমবার দেশকে বাঁচিয়েছি পারমাণবিক শক্তি দিয়ে, দ্বিতীয়বার বাঁচিয়েছি সব দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে।’

ড. আব্দুল কাদির খান, পাকিস্তানের পরমাণু শক্তির জনক

খান নেদারল্যান্ডস থেকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার সেন্ট্রিফিউজের নকশা এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাকিস্তানে নিয়ে আসেন বলে পরে অভিযোগ ওঠে। যদিও খান বলেছিলেন, তিনি এসব নিজের মেধা ও গবেষণার মাধ্যমে পেয়েছেন। নেদারল্যান্ডসের আদালত ১৯৮৩ সালে তাকে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে দোষী সাব্যস্ত করলেও পরে সেই রায় বাতিল হয়।

এরপর গোপনে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সহায়তায় একে একে গড়ে ওঠে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের সেন্ট্রিফিউজ ফ্যাসিলিটি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আনার জন্য একের পর এক ফ্রন্ট কোম্পানি খোলা হয়। বিদেশ থেকে আমদানি করা যন্ত্রপাতি যাতে সন্দেহ জাগায় না, সেজন্য বলা হতো এগুলো নতুন টেক্সটাইল মিলে ব্যবহার হবে।

১৯৭৭ সালে পাকিস্তানে জিয়াউল হক সামরিক অভ্যুত্থান করে ক্ষমতায় বসেন। সামরিক সরকারের কাছেও খান নিজের কর্মসূচির গুরুত্ব বোঝাতে সক্ষম হন। সামরিক প্রশাসন তখন তাকে সব রকমের সহায়তা দিতে শুরু করে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী জানত, ভারতের পরমাণু শক্তির জবাব দিতে গেলে পাকিস্তানেরও পারমাণবিক শক্তি অর্জন করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

এদিকে পশ্চিমা দেশগুলোও পাকিস্তানের কর্মসূচি নিয়ে আশঙ্কায় ছিল। ইসরাইল বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তাদের আশঙ্কা ছিল, পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তি অর্জন করলে মুসলিম বিশ্বের কাছে শক্তির নতুন কেন্দ্র হয়ে উঠবে এবং এক সময় সেই প্রযুক্তি আরব দেশগুলোতে ছড়িয়ে যেতে পারে, যে শঙ্কাটা পরে কিছুটা সত্যিও হয়েছিল।

‘যদি জানতাম কাদের খান কী করতে যাচ্ছে, তাহলে তাকে হত্যা করে ইতিহাসের গতিপথই বদলে দিতাম।’

শাবতাই শাভিত, সাবেক প্রধান, মোসাদ

ইসরাইল ভারতের কাছে প্রস্তাব দেয় যে, পাকিস্তানের পারমাণবিক কেন্দ্র ধ্বংস করতে দুই দেশ একসঙ্গে হামলা চালাবে। ইন্দিরা গান্ধী প্রথমে সম্মতি দিলেও পরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় পরিকল্পনা বাতিল করেন।

এর মধ্যে একের পর এক হত্যাচেষ্টা, হুমকি আর ষড়যন্ত্রে মুখে পড়েছে খানের এই কর্মসূচি। তাতেও তিনি তা বন্ধ করেননি, চালিয়ে যান আগের গতিতেই। ইউরোপের বিভিন্ন কোম্পানি যারা পাকিস্তানকে যন্ত্রাংশ সরবরাহ করত, তাদের ওপর হামলার চেষ্টাও হয়। এক জার্মান ব্যবসায়ীর কাছে উড়ো চিঠিও পাঠানো হয়। এমনকি খানের ওপরও গুপ্তহত্যার প্রচেষ্টা হয়।

যদিও মোসাদ তাকে হত্যায় ব্যর্থ হয়, কিন্তু তারা খানের ওপর নজরদারি চালিয়ে যেত। পরে মোসাদের সাবেক প্রধান শাবতাই শাভিত বলেছিলেন, ‘যদি জানতাম কাদের খান কী করতে যাচ্ছে, তাহলে তাকে হত্যা করে ইতিহাসের গতিপথই বদলে দিতাম।’

কিন্তু এ কিউ খানের জীবনের সবচেয়ে বিতর্কিত অধ্যায় শুরু হয় এরপরই। তিনি গোপনে এক আন্তর্জাতিক পারমাণবিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন, যার মাধ্যমে ইরান, উত্তর কোরিয়া ও লিবিয়ার মতো দেশে পারমাণবিক প্রযুক্তি পৌঁছে যেতে থাকে।

১৯৮৬ সাল নাগাদ পাকিস্তান প্রায় পরিপূর্ণ পারমাণবিক ক্ষমতা অর্জন করে। ১৯৯৮ সালে ভারতের পাঁচটি পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর পর পাকিস্তানও বেলুচিস্তানের চগাই অঞ্চলে ছয়টি পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেদের শক্তি প্রকাশ্যে ঘোষণা করে। পাকিস্তান হয়ে যায় বিশ্বের সপ্তম পরমাণু শক্তিধর দেশ।

পাকিস্তানে একিউ খানকে বীরের মর্যাদা দেওয়া হয়। তাকে নিয়ে রাস্তাঘাট, স্কুল, এমনকি ক্রিকেট টিমেরও নাম রাখা হয়। টিভিতে এসে তিনি বলেছিলেন, ‘অ্যাটম বোমা কে বানিয়েছে? আমি বানিয়েছি। মিসাইল কে বানিয়েছি? আমি বানিয়েছি তোমাদের জন্য।’

কিন্তু এ কিউ খানের জীবনের সবচেয়ে বিতর্কিত অধ্যায় শুরু হয় এরপরই। তিনি গোপনে এক আন্তর্জাতিক পারমাণবিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন, যার মাধ্যমে ইরান, উত্তর কোরিয়া ও লিবিয়ার মতো দেশে পারমাণবিক প্রযুক্তি পৌঁছে যেতে থাকে।

খান পাকিস্তানের জন্য যত যন্ত্রাংশ আনাতেন, তার চেয়ে বেশি আনিয়ে অতিরিক্ত অংশ গোপনে বিক্রি করতেন। এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশ এবং উত্তর কোরিয়ার কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি পৌঁছে যায়। ইরানের সঙ্গে পাকিস্তানের এই গোপন সমঝোতার কথা জানতেন না এমনকি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোও। ১৯৮৯ সালে তেহরান সফরে গিয়ে ইরানি প্রেসিডেন্ট তাকে জানান, ‘আমরা পারমাণবিক প্রযুক্তির বিষয়ে আমাদের সমঝোতা নবায়ন করব তো?’, বেনজির তখন হতবাক হয়ে যান। তখনই তিনি জানতে পারেন এ বিষয়ে।

২০০৩ সালে লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পেতে গিয়ে খানের গোপন নেটওয়ার্কের কথা ফাঁস করে দেন। গাদ্দাফি জানান, খান লিবিয়ার জন্য গোপনে পারমাণবিক স্থাপনা তৈরি করছেন যা বাইরে থেকে মুরগির খামার মনে হবে। সিআইএ একাধিক চালান জব্দ করে, যাতে ইসলামাবাদের এক ড্রাইক্লিনার থেকে নকশাও পাওয়া যায়।

২০০৪ সালে বিশ্বজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। পাকিস্তানে টেলিভিশনে এসে খান স্বীকার করেন, তিনিই গোপনে প্রযুক্তি বিক্রি করেছেন। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, সরকারের কেউ এতে জড়িত নয়। পাকিস্তান সরকার দ্রুত তাকে ক্ষমা করে, যদিও তার ওপর গৃহবন্দি থাকার শর্ত আরোপ করে। তবে প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ তাকে ‘আমার নায়ক’ বলে অভিহিত করেছিলেন।

এ কিউ খান বলেছিলেন, ‘আমি প্রথমবার দেশকে বাঁচিয়েছি পারমাণবিক শক্তি দিয়ে, দ্বিতীয়বার বাঁচিয়েছি সব দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে।’

*মিডল ইস্ট আই থেকে অনূদিত ও সংক্ষেপিত

 

 

কিউএনবি/আয়শা//০২ জুলাই ২০২৫,/বিকাল ৩:৩৪

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

July 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit