ডেস্ক নিউজ : এখন শুধু কোটা সংস্কার চায় না ছাত্র সমাজ; রাষ্ট্রব্যবস্থারও সংস্কার চায় তারা। শুরু হয় একদফা আন্দোলন। লক্ষ্য সরকারের পতন। স্বল্পকালীন অথচ ব্যাপক রক্তক্ষয়ী ছাত্র—জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট সরকার প্রধান পদদ্যাগ করতে বাধ্য হন। পালিয়ে যান প্রতিবেশি দেশ ভারতে। পতন হয় স্বৈরাচারের। অবসান ঘটে স্বৈর শাসনের। আলহামদুলিল্লাহ!
শুরুর দিকে আন্দোলনটি ছিল নির্দিষ্ট একটি বিষয় কেন্দ্রিক। নির্দিষ্ট একটি শ্রেণির আন্দোলন। শেষের দিকে এসে আন্দোলনের লক্ষ্য ও প্রকৃতি পরিবর্তন হয়েছে। কোটা সংস্কার থেকে মোড় নিয়েছে রাষ্ট্র সংস্কারে। ছাত্র আন্দোলন থেকে গণ আন্দোলনে। তাই এ আন্দোলনের শুরুটাকে আমি ‘কোটা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ বললেও শেষের অংশটাকে সরকার বিরোধী ‘গণ আন্দোলন’ ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন’ কিংবা ‘ন্যায় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন’ নামে অভিহিত করতে চাই। গোটা আন্দোলনকে ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে অভিহিত করাটা আমি যুৎসই মনে করি না।
বলা হয়ে থাকে لكل اسم نصيب من مسماه নামেরও প্রভাব পড়ে কামের উপর। নামকে পঁুজি করে অনেক সময় সুবিধাভোগীরা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। জুলাই—আগস্ট আন্দোলনের সাথে বৈষম্য এবং ছাত্র এই দুটি শব্দের বিশেষ উল্লেখ আন্দোলনের সঠিক লক্ষ্যকে দিকভ্রান্ত করতে পারে। গণ আন্দোলনের ফসল কুক্ষিগত হতে পারে শ্রেণিবিশেষের কাছে। যা আমাদের কারোরই কাম্য নয়।
বৈষম্য এবং সাম্য শব্দদুটি এখন দেশে সর্বাধিক উচ্চারিত শব্দ। আলোচিত শব্দ। টক অব দ্য কান্ট্রি। বৈষম্য বিরোধিতা আলোকিত এক অভিযাত্রা। বিপ্লবী কর্ম। বৈপ্লবিক চেতনা। বৈষম্যবিরোধী স্লোগান বিপ্লবের স্লোগান। সাম্য প্রতিষ্ঠা, বৈষম্যের বিরোধিতা দেশপ্রেমের প্রতীক। দায়িত্বশীল নাগরিকতা ও সচেতনতার প্রমাণ।
মানুষের ধারণা, বৈষম্যের বিপরীত শব্দ সাম্য। সর্বত্র সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলেই বৈষম্য দূর হয়ে যাবে। সমাজ ও রাষ্ট্র হয়ে যাবে সুন্দর। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সাম্য সকল দিক থেকে বৈষম্য শব্দের বিপরীত শব্দ নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাম্যের সাথে বৈষম্য একত্র হতে পারে। যদি বৈষম্যের সম্পূর্ণ বিপরীত শব্দই হতো সাম্য, তাহলে সাম্য আর বৈষম্য কখনো একত্র হতো না। কারণ পরস্পর বিপরীত দুটি জিনিস কখনো একত্র হতে পারে না। অথচ সাম্য ও বৈষম্য অনেক বিষয়ের ক্ষেত্রেই একত্র হতে পারে।
এতে বোঝা যায় সাম্য আর বৈষম্য সম্পূর্ণ বিপরীত বিষয় নয়। কোনো কোনো সাম্যেও বৈষম্য থাকতে পারে। তাই সমতা প্রতিষ্ঠা সকল সমস্যার সমাধান নয়। সকল ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করারও তেমন কোনো যৌক্তিকতা নেই।
আলোচনার এ পর্যায়ে আদল, সাম্য ও ইহসানের পরিচয় অধিকতর স্পষ্ট করে তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। আদল বা ন্যায় (Dialectic, Righteousness) : আদল বা ন্যায় হলো প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার ন্যায্য অংশ প্রদান করা। প্রাপ্য প্রদানে হ্রাস—বৃদ্ধি না করা। আদল বা ইনসাফ ইসলামের নিউট্রাল পজিশন। সর্বক্ষেত্রে ইসলাম আদল ও ইনসাফের নির্দেশ দিয়ে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষ ইনসাফেরও উর্ধ্বে ওঠে ইহসান তথা অনুগ্রহ অনুকম্পার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, إنَّ اللهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَان। ‘আল্লাহ তাআলা ইনসাফ ও বদান্যতার নির্দেশ দেন’।
আদল ও ইহসানের পার্থক্য বোঝার জন্য নবী জীবনী থেকে একটি ঘটনা হাজির করি। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের রা. বলেন, জনৈক আনসারি নবীজী সা. এর সামনে জুবায়ের রা. এর সাথে হাররার নালার পানির ব্যাপারে ঝগড়া করল। যে পানি দ্বারা তারা খেজুর বাগান সেচ দিতেন। অতঃপর তারা উভয়ে নবীজী সা. এর কাছে এ নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হলে আল্লাহর রাসূল সা. জুবায়ের রা. কে বললেন,
হে জুবায়ের! প্রথমে তোমার জমি সেচ করে নাও। এরপর তোমার প্রতিবেশীর দিকে পানি ছেড়ে দাও।’ এতে আনসারি ব্যক্তি অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, সে আপনার ফুফাতো ভাই বলে এমন ফায়সালা করেছেন। এতে রাসূলুল্লাহ সা. এর চেহারায় অসন্তুষ্টির লক্ষণ প্রকাশ পায়। এরপর তিনি বললেন, ‘হে জুবায়ের! তুমি নিজের জমি সেচ করো। এরপর পানি আটকে রাখো, যেন তা বাঁধ পর্যন্ত পৌঁছে যায়।’ হজরত জুবায়ের রা. বলেন, আল্লাহর কসম, আমার মনে হয় এ আয়াতটি এ সম্পর্কেই নাজিল হয়েছে— ‘আপনার প্রতিপালকের শপথ, তারা মুমিন হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদের বিচার আপনার ওপর অর্পণ করবে না।’ (সূরা নিসা—৬৫) (সহিহ বুখারি—২৩৬১)
এই ঘটনায় রাসুল সা. এর প্রথম ফায়সালা ছিল ইহসানের উপর। দ্বিতীয় ফায়সালাটি করেছেন রাসুল আদলের ভিত্তিতে। সাম্য (Equality): সর্ববিষয়ে সবার জন্য সমতা বিধান করাকে সাম্য বলে। সাম্য বলতে মানুষের জীবনের এক ধরনের পরিবেশকে বোঝায়, যেখানে জাতি-গোত্র-বর্ণ-ধর্ম ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয় এবং সবাইকে সমানভাবে ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও আত্মবিকাশের সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়। সাম্য মানে সামাজিক ভেদাভেদহীন, মুক্ত-স্বাধীন সমঅধিকারের একটি সমাজের স্বপ্ন দেখা। যেখানে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তথা সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধার একটি পরিবেশ থাকবে।
বাহ্য দৃষ্টিতে সাম্য বিষয়টি খুবই চমকপ্রদ ও অন্তরে প্রশান্তিদায়ক। কিছু কিছু বিষয়ের ক্ষেত্রে বাস্তবেও তাই। যেমন: মানবিক মর্যাদা, নাগরিক অধিকার, আইনকানুন, বিচার—আচার, দণ্ড—পুরস্কার, শিক্ষা—সংস্কৃতি ইত্যাদি।দ কিন্তু সবক্ষেত্রে সমতা বিধানের বৈধতা ইসলাম দেয় না। সমতা তো কমিউনিজমের দর্শন। সমতা থাকুক বা না থাকুক আদল বা ইনসাফ মাত্রই আল্লাহ ও বান্দার হকের রক্ষাকবচ। পক্ষান্তরে অনেক সাম্যে আদল বা ইনসাফই থাকে না। তৈরি হয় নতুন বৈষম্য।
এমন অনেক বিষয় আছে, যেগুলোতে সাম্য সমাধান নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে এমনকি যুক্তির নিরিখেও সমতার ধারণা সেসব ক্ষেত্রে সঠিক নয়। সকল বিষয়ে গ্রহণযোগ্যও নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমতা তো খুদই বৈষম্য। সাম্যেও বৈষম্য থাকতে পারে। আপনি নারী পুরুষকে উত্তরাধিকার সম্পদসহ যাবতীয় বিষয়ে সমান অধিকার দিলেন। সাম্য হলো। বৈষম্যও রয়ে গেল। সিনিয়র জুনিয়রকে বেতন ভাতায়, সুযোগ সুবিধায় একপাল্লায় মাপলেন। সাম্য হলো। বৈষম্যও রয়ে গেল। এক ব্যক্তির দুই স্ত্রী। একজনের সাথে ৫ সন্তান, আরেকজনের সাথে ১ সন্তান। উভয়কে সমান খরচ দিলেন। সাম্য হলো।
বৈষম্যও রয়ে গেল। সমযোগ্য ও সমপদের দুজন মানুষ। একজনের কাছ থেকে বেশি সময় বেশি কাজ এবং আরেকজনের কাছ থেকে কম সময় কম কাজ নিয়ে সমান বেতন দিলেন। সাম্য হলো। বৈষম্যও রয়ে গেল। একছেলে পড়ে ইউনিভার্সিটিতে। থাকে শহরে। আরেক ছেলে পড়ে প্রাথমিকে বা মাধ্যমিকে। থাকে গ্রামে। দুজনের জন্য সমান হারে খরচ বরাদ্দ করলেন। সাম্য হলো। বৈষম্যও রয়ে গেল। কারণ এসকল ক্ষেত্রে বাস্তবিক প্রয়োজন ও ন্যায্যতার প্রতি লক্ষ্য করা হয়নি। একজনকে ন্যায্য পাওনার বেশি দেওয়া হয়েছে। আরেকজনকে ন্যায্যটাও নিশ্চিত করা হয়নি।
অতএব শুধু বৈষম্য দূরীকরণ চূড়ান্ত সমাধান নয়। আদল বা ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করাই চূড়ান্ত সমাধান। কুইনিন জ্বর সারাবে। কিন্তু কুইনিন সারাবে কিসে? বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন সাম্য প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু সাম্যের বৈষম্য দূর করবে কিসে? সেটা নিয়েও ভাবা উচিত।
লেখক: মাদরাসা দারুর রাশাদ
কিউএনবি/অনিমা/০৯ মার্চ ২০২৫,/রাত ৮:৩৪