শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ০২:১৮ অপরাহ্ন

রুমকী’র কথা, রুমকী’র চিঠি-৪ : দুঃখবিলাস

লুৎফর রহমান। রাজনীতিবিদ ও লেখক।
  • Update Time : শুক্রবার, ৪ আগস্ট, ২০২৩
  • ৭৫১ Time View

দুঃখবিলাস
————-
গোধূলী বেলার সমুদ্র তীর। বালুকা বেলায় আঁচড়ে পড়ছে সমুদ্রের সফেন ঢেউ। ফেনাযুক্ত সে ঢেউ ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে নাহিদ ও রুমকীর পাঁয়ে। মাঝ সমুদ্রে কি চমৎকার ভাবে ডুবে যাচ্ছে সূর্যটা। চারিদিকে স্বর্ণালী আভা ছড়িয়ে সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে। রুমকী নাহিদের হাতটা ধরে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু কি এক অজানা কারণে নাহিদ ছুটে যাচ্ছে রুমকীর কাছ থেকে। রুমকী নাহিদকে ধরে রাখতে পারছেনা।

রুম হিটারটা দেয়া ছিলনা। এরপরেও রুমকী ঘেমে একাকার। গলার কাছে ঘাম চপ চপ করছে। রুমকীর ঘুম ভেঙে গেছে। এতক্ষন তাহলে নাহিদকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিল সে । স্বপ্নটার বাস্তবতা রুমকী তাদের নিজের জীবনেও দেখতে পেয়েছে। নাহিদকে সে ধরে রাখতে পারেনি। রাজনীতি নামক দানবটা সব তছনছ করে দিয়েছে তাদের জীবনটা। ৮০ এর দশকে স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডামাডোলে সব কিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। স্বপ্নের জালে আঘাত হেনেছে সন্ত্রাস নামক দানবটা । হুলিয়া নিয়ে পলাতক জীবন বেছে নিয়েছিল নাহিদ। রুমকীর সব স্বপ্ন বন্দী হয়েছে কখনো কখনো কারাগারের নিস্প্রান দেয়ালের মাঝে।

ভোর হয়েছে। নিউ ইয়র্কের কুইন্সে সূর্যটা উঠছে। রুমকী রুম থেকে বের হয়ে ফ্ল্যাটের বারান্দায় গিয়ে ইজি চেয়ারে বসল। হাতে সেলফোনটা। স্বপ্নের কথা ভাবছে রুমকী। এইতো কিছুক্ষন আগে সে স্বপ্নে দেখেছিল, লাল আভা ছড়িয়ে সূর্য ডুবে যাচ্ছে সমুদ্রের মাঝে। আর এখন দেখছে বাস্তবে, লাল আভা ছড়িয়ে সূর্য উদিত হচ্ছে। এই জীবনে কখনো সূর্য উদিত হয়, কখনো অস্ত যায়।আহারে জীবন !

বাংলাদেশে এখন পড়ন্ত বিকেল। নাহিদকে কল করল রুমকী। অবশ্য গতকালকেই নাহিদকে হোয়াটস্যাপ এ টেক্সট করেছিল রুমকী। শুধু চিঠি লিখলে একঘেয়েমিতে পেয়ে বসতে পারে। এজন্যে মাঝে মাঝে আমরা কথাও বলবো। রুমকী’র হোয়াটস্যাপ কল সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করল নাহিদ।

অবাক হল নাহিদ। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে রুমকী। বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল নাহিদ। বারবার জিজ্ঞাসা করছে কি হয়েছে তোমার ? কিছুক্ষন পর প্রকৃতস্ত হয়ে রুমকী জানতে চাইল, কেমন আছ নাহিদ ? ভাল আছি, কিন্তু কি হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন? জানতে চাইল নাহিদ। রুমকী স্বপ্নের কথা বলল। আমি তোমার হাত ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিলাম। কিন্তু কিছুতেই তোমাকে ধরে রাখতে পারলাম না নাহিদ। আবারো কেঁদে ফেলল রুমকী। নাহিদ বলল, এত আমাদের বাস্তব জীবনের দৃশ্যপট। এতো স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। তুমিও আমাকে ধরে রাখতে পারোনি, আমিও তোমাকে পাইনি। রাজনীতি আমাদের মাঝে বিভাজন সৃষ্টি করে দিয়েছে। সব আমাদের দুর্ভাগ্য।

কি হল সেই রাজনীতি করে ? কি পেলে তুমি ? কি পেল বাংলাদেশ ? রুমকী জানতে চাইল। নাহিদ একটা ধীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, সে হিসাব মেলাতে পারিনা। সব হারিয়েও যদি যে গণতন্ত্রের জন্যে লড়াই করেছিলাম, সেটা যদি অর্জিত হত, বিশ্বাস কর রুমকী, কোন দুঃখ, কোন ক্লেশ অনুভব করতাম না। কিন্তু এখন মনে হয় আমি যেমন হারিয়েছি তোমাকে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশ হারিয়েছে তার আসল অবয়বকে। যে মূলনীতির উপর ভিত্তি করে ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে, সেই মূলনীতি গুলো আমরা গলাটিপে হত্যা করেছি।

রুমকী বলল, এই বাংলাদেশ দেখতে চায়নি মুক্তিযোদ্ধারা। এই বাংলাদেশের জন্যে জীবন দিতে হবে এটা যেমন ভাবেনি সেদিনের যোদ্ধারা, ঠিক তেমনি ৮০ এর দশকে স্বৈরাচার হটিয়ে এই গণতন্ত্রের জন্যে অকাতরে জীবন দিতে হবে, এটাও ভাবেনি তখনকার ছাত্র জনতা। আফসোস নাহিদ। বড়ই আফসোস। নাহিদ পাল্টা জবাব দিল, আফসোস করে আর কি হবে? রাষ্ট্র এখন দলীয় বিভাজনের শিকার। নির্বাচন প্রক্রিয়া সেই কবেইনা ধ্বংস হয়েছে। জনগণ এখন আর ভোটকেন্দ্রে যায়না। কিছুদিন আগে ঢাকায় এক আসনে উপনির্বাচন হয়ে গেল। ভোটকেন্দ্রে ভোটার দেখিনি। রুমকী বলল, এমনিতেই মন খারাপ আমার। আর মন খারাপের কিছু শুনতে চাইনা। তুমি একটা গল্প বলো। নাহিদ হেসে বলল, একটা সত্যি গল্প বলছি। গল্পটা শুনলে তোমার মন আরও খারাপ হবে। নাহিদ গল্প শুরু করল।

বিলাস এর বাবা থাকতে বাবা নেই। মা থাকতে মা নেই। বিলাসের বাবা একজন মফস্বলের আর্টিস্ট। সাইনবোর্ড লিখে, ছবি এঁকে, ছবি বাঁধাই করে জীবিকা নির্বাহ করে। বিলাসের বাবার নাম লতিফ। তার মায়ের নামে দোকানের নামকরণ করেছে ”মায়া আর্ট ঘর”। মোটামোটি ভালোভাবেই সংসার চালায় লতিফ। লতিফের দুই স্ত্রী। প্রথম পক্ষে দুটি মেয়ে। বিলাস দ্বিতীয় পক্ষের ছেলে। ৮ বছর বয়সে বিলাসের মা পাশের এক দোকানদারের সাথে পালিয়ে গিয়ে পার্শ্ববর্তী জেলায় গিয়ে নতুন করে সংসার শুরু করে। বিলাসকেও সাথে নিয়ে যায়। অনেক কষ্টের জীবন অতিবাহিত করে এইচ এস সি পাশ করে একদিন পুলিশ নিয়োগের লাইনে দাঁড়ায় বিলাস । সৌম্য সুন্দর ,হ্যান্ডসাম বিলাস মেধাবী ছাত্র। পুলিশের কনস্টেবল পদে প্রাথমিক ও লিখিত পরীক্ষায় বিলাস টিকে গেল। ভাইবাতে খুব ভাল করল সে । এখন ফাইনাল রিক্রুটিং এর জন্যে বিলাসের পুলিশ ভেরিফিকেশন শুরু হল। এখানেই শুরু হল বিপত্তি।

বিলাস তার বাবার ঠিকানা দিয়েছিল। ঠিকানা মোতাবেক পুলিশ বিলাসের বাড়ি ঘর দেখে। বিলাসের বাবার ঘরে টিনের বেড়ায় ঝুলছে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার ছবি। পুলিশ এই ছবি দেখে বিরাট কিছু যেন আবিষ্কার করে ফেলল। বিলাস তাহলে বিএনপি করে ? বিলাসের সৎ বড়বোন পুলিশকে জানাল , বিলাস কোন রাজনীতি করেনা। তাছাড়া বিলাসতো এ বাড়িতেই থাকেনা। পুলিশ জানতে চাইল, তাহলে জিয়া, খালেদা জিয়ার ছবি কেন বাড়ীতে ? বিলাসের বোন সত্যি কথাটাই পুলিশকে জানাল। বাবা আর্টিস্ট, বিক্রির জন্যে দোকানে এই ছবিগুলো ছিল। সরকারী দল এই ছবি দেখলে দোকান ভাঙচুর করতে পারে বলে বাবা এগুলো বাড়ীতে এনেছে। পুলিশেরা সব শুনে বিদায় হল। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে নিয়ে বিলাসের বাবা লতিফ আর্টিস্ট এসপির সংগে দেখা করে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার ছবি রাখার ব্যাখ্যা দিল। লতিফ কোন পার্টি করেনা, জানাল এসপিকে।

রুমকী জানতে চাইল তারপরে কি হল বিলাসের ? নাহিদ হেসে বলল, কি হবে আর বিলাসের ? বিলাসের জীবন দুঃখবিলাসময়। বাবা থাকতেও বিলাসের বাবা নেই, মা থাকতেও মা নেই। বিএনপি না করেও জিয়া, খালেদা জিয়ার ছবির কারণে তার চাকুরীও নেই। এসপি সব জানলেও ঝুঁকি নিতে নারাজ। বিলাসকে চাকুরী দিয়ে আবার তিনি না জামায়াত শিবিরের দোসর বনে যান। বিলাস এখন রিকশা চালায়। রুমকী ধীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোনলাইন কেটে দিল।

 

লেখকঃ লুৎফর রহমান একজন রাজনীতিবিদ ও লেখক। তিনি নিয়মিত লেখালেখির পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক নিউজ মিডিয়ার সম্পাদক ও প্রকাশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র লুৎফর রহমান ৮০ এর দশকের স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরতে দুটি রাজনৈতিক উপন্যাস লিখেছেন, যা দেশ বিদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় জীবনের খন্ডচিত্র এঁকে তিনি এখন ব্যাপক পরিচিত।

 

 

কিউএনবি/নাহিদা/০৪.০৮.২০২৩/ রাত ১০.১৫

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

October 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit