মঙ্গলবার, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:৪৪ অপরাহ্ন

হারিয়ে যাচ্ছে যাত্রাপালা

Reporter Name
  • Update Time : শনিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৫
  • ৩৫ Time View

বিনোদন ডেস্ক : গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী যাত্রাশিল্প ধুঁকে-ধুঁকে চলছে। খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে দাঁড়িয়েছে খাদের কিনারে। অবহেলা-অনাদরে শিল্পটির জাদুঘরে ঠাঁই নেওয়ার অবস্থা। বর্তমানে দেশের কোথাও যাত্রাপালা প্রদর্শনের অনুমতি পাওয়া যায় না। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত দলগুলোর মালিক, অভিনেতা, অভিনেত্রীদের অধিকাংশই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকেই যাত্রাপালা ছেড়ে বেছে নিয়েছেন অন্য কাজ। সবমিলিয়ে যাত্রাশিল্পে করুণ অবস্থা বিরাজ করছে।

এই শিল্পে খরা দেখা দেওয়ায় এর সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যবসাও প্রায় মরে গেছে। বর্তমান দুরবস্থার কারণে গ্রামগঞ্জের নতুন প্রজন্ম ঐতিহ্যবাহী যাত্রাশিল্প সম্পর্কে কিছুই জানতে পারছে না। বড়দের কাছে গল্প শুনে তাদের মাঝে যাত্রাপালা দেখার আগ্রহ জন্মালেও তা পূরণ হচ্ছে না। প্রশাসনের অনুমতির অভাবে যাত্রাপালা প্রদর্শনী প্রায় বন্ধের পথে। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা যুগান্তরের কাছে তাদের ক্ষোভ ও মনোবেদনার কথা জানান।
তারা বলেন, দেশে জাতীয় নাট্যশালা হয়েছে, সিনেমার জন্য এফডিসি এসেছে। কিন্তু এখনো যাত্রাপালা প্রদর্শনের জন্য একটা স্থায়ী যাত্রামঞ্চ হয়নি। তারা বলেন, শিল্পকলা থেকে জেলা প্রশাসনের কাছে যাত্রাপালা প্রদর্শনের জন্য চিঠিপত্র দেওয়া হয়। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন যাত্রাপালা করার অনুমতি দেয় না। স্থানীয় লোকজনও অনেক সময় যাত্রার প্যান্ডেল করতে দেখলেই সব বন্ধ করে দেয়। যেসব যাত্রাদলের বিরুদ্ধে অশ্লীল নাচগানের অভিযোগ নেই, তাদের ক্ষেত্রেও সমস্যার ধরন একই।

যাত্রানুষ্ঠানের অনুমতি প্রদানের দায়িত্ব প্রত্যেক জেলা প্রশাসনের। কিন্তু প্রশাসন থেকে অনুমতি না দেওয়ার কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সারা দেশে সে অর্থে যাত্রা প্রদর্শনী হয়নি। শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে কয়েকটি যাত্রাপালা উৎসব ছাড়া অন্য কোথাও তেমন কিছু হয়নি। এতে পেশাদার যাত্রাশিল্পীদের জীবন-জীবিকার সংকট চরম আকার ধারণ করছে।

দেশে বর্তমানে ডায়মন্ড যাত্রা হাউজ, আনন্দ অপেরা, চৈতালি অপেরা, সোনার বাংলা অপেরা, মহানন্দা অপেরা, সুন্দরবন অপেরাসহ আরও অনেক রুচিশীল যাত্রাপালার দল আছে। কিন্তু অনুমতি না পাওয়ার কারণে কোথাও যাত্রাপালা হচ্ছে না। সাধারণত দুর্গাপূজার সময় থেকে যাত্রাপালা প্রদর্শনের মৌসুম শুরু হয়। কিন্তু যাত্রাসংশ্লিষ্ট শিল্পীদের অভিযোগ, তারা একটা প্যান্ডেল দিয়ে মহড়াও করতে পারছেন না। কারণ, যাত্রার প্যান্ডেলের নাম শুনলেই কিছু মানুষ এসে সব ভন্ডুল করে দেয়।

বাংলাদেশ যাত্রাশিল্পী মালিক সমিতির একাংশের সভাপতি এম আলম লাভলু যুগান্তরকে বলেন, দেশে যাত্রাশিল্প এবং যাত্রাশিল্পী সবার করুণ দশা। নানা পরিবর্তন হয়। সরকার আসে সরকার যায়। কিন্তু যাত্রাশিল্পের কোনো পরিবর্তন হয় না। যাত্রাশিল্পীদের নিয়েও কেউ ভাবে না। অথচ নানা পৃষ্ঠপোষকতাধর্মী আয়োজনে যাত্রাশিল্পীদের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই শিল্প এবং শিল্পের মানুষ কীভাবে টিকে আছেন, সেই খবর কেউ রাখে না।

এদিকে যাত্রাপালার সার্বিক উন্নয়নে শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল কয়েক বছর আগে। যাত্রাদলের নিবন্ধনের ব্যবস্থাও করা হয়। এখন পর্যন্ত নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ২০৫টি। জানা যায়, যেসব দলের বিরুদ্ধে অশ্লীলতা প্রদর্শনের অভিযোগ আছে, তেমন বেশকিছু দলকে বাদও দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির যাত্রাশিল্প এবং যাত্রাপালার বিষয়গুলো দেখাশোনা করেন পূর্ণলাক্ষ চাকমা। তিনি যুগান্তরকে বলেন, শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে নানাভাবে দেশের যাত্রাশিল্প ও শিল্পীদের উন্নয়নে কাজ করা হচ্ছে। আমরা নতুন পালা নিয়েও কাজ করছি। আশা করছি, এবারও যাত্রাপালা উৎসব হবে।

তবে শিল্পকলা একাডেমির এই উদ্যোগ নিয়েও পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন যাত্রাশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। তাদের কেউ কেউ যুগান্তরক বলেন, শিল্পকলা একাডেমি যাত্রাশিল্পকে নতুনভাবে জাগিয়ে তুলতে চাইলেও শেষ রক্ষা হয়নি। জেলায় জেলায় নিয়মিত যাত্রাপালা প্রদর্শনের অনুমতি পাওয়ার ব্যবস্থা তারাও করে দিতে পারেনি। যাত্রাশিল্প এবং শিল্পীদের উন্নয়নে কিছু কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলোর মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা। পাশাপাশি অনেকে জানিয়েছেন, শিল্পকলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক যাত্রাদলগুলোর যাত্রা প্রদর্শনী বাবদ বাজেটের সামান্য একটা অংশই শুধু দলগুলোকে দিতেন।

দেশের যাত্রাশিল্প নিয়ে গবেষণা করেন লেখক ও শিল্পী মিলন কান্তি দে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, যাত্রার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ আজ আর ভালো নেই। যাত্রা প্রদর্শনের জন্য আলাদা একটা মঞ্চ আজও হলো না। যাত্রাশিল্প যেন জাদুঘরে সংরক্ষিত হওয়ার বিষয়টিও প্রহর গুনছে। যাত্রাপালা প্রদর্শনের অনুমতি পাওয়া যাচ্ছে না আজও। তিনি বলেন, দেশের যাত্রাশিল্পীদের মধ্যে যারা বিখ্যাত ছিলেন, তাদের বেশির ভাগ মারা গেছেন। গুণী অভিনেতা-অভিনেত্রী যে কয়েকজন আছেন, তাদেরও শারীরিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভালো নয়।

যাত্রাশিল্পীদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে যাত্রাশিল্প নীতিমালা গেজেটভুক্ত হলেও এর কোনো সুফল আমরা পাইনি। শুধু ২০৫টি যাত্রাদল নিবন্ধিত হয়েছে। প্রধান যে সমস্যা জেলা প্রশাসনে অনুমিত পাওয়া, সেটি আজও একই রকম রয়ে গেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর আমরা নানাভাবে যাত্রাশিল্পের বিকাশে অন্তরায়ের কথা তুলে ধরছি। আশা করব, বর্তমান সরকার দেশজ সংস্কৃতি ঐতিহ্যবাহী এই যাত্রাশিল্পের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে জোর ভূমিকা রাখবেন। বিশেষ করে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে যাত্রাপালা প্রদর্শনীর অনুমতি নিয়ে যে জটিলতা, সেটি দূর করবে চিরতরে।

 

 

কিউএনবি/আয়শা/১৬ আগস্ট ২০২৫/বিকাল ৫:৪০

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

September 2025
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit