দেশ জাহাজ
—————-
আমার দেশটা আমার কাছে একটা আধুনিক লঞ্চের মতো মনে হয়।ধরা যাক লঞ্চটির নাম সুন্দরবন ১৬। বাস্তবে কিন্তু এই লঞ্চটি সমুদ্রগামী বড় জাহাজের আদলে তৈরি হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য। আধুনিক সাজসজ্জা, নির্মাণশৈলি ও প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছে লঞ্চটিতে। যা অত্যন্ত বিলাসবহুল । অনেকটা বাংলাদেশের মতোই।
সুন্দরবন ১৬ লঞ্চে রয়েছে নিরাপত্তার জন্য সিসি ক্যামেরা, শিশুদের জন্য বিনোদন স্পেস, ফুডকোর্ট, ফার্মেসি, আধুনিক অগ্নিনির্বাপক,উন্মুক্ত ওয়াই-ফাই,হৃদরোগে আক্রান্তদের জন্য রয়েছে করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ)। লঞ্চের ভেতর ওঠানামার জন্য আবার ক্যাপসুল লিফট ও।
ঠিক তেমন ই বাংলাদেশেও রয়েছে এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে,পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল,খাবারের মধ্যে রয়েছে সোনার তৈরী লাখ টাকার জিলাপি,লেখাপড়ার জন্য যুক্ত হয়েছে কোটী টাকার প্রিমিয়াম স্কুল হেলবেরি ভালুকা, চিকিৎসা সেবার জন্য রয়েছে লাক্সারী স্কয়ার শেপের ইউনাইটেড কিছু হসপিটাল।
চারতালা বিশিষ্ট সুন্দরবন ১৬ লঞ্চে রয়েছে তারতম্যকারী অনেকগুলো কেবিনের সুব্যবস্থা। প্রিমিয়াম ভিভিআইপি কেবিন, ভিআইপি কেবিন, ডিলাক্স কেবিন, ফ্যামিলি কেবিন, ডাবল ও সিংগেল কেবিন, এবং কিছু সোফা। নিচ তলায় রয়েছে বিশাল খালি স্পেস, যারা কেবিন ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করতে পারে না তাদের জন্য ফ্লোরিং করে কোনোমতে গন্তব্যে যাওয়ার সুব্যবস্থা, যাকে বলে ডেক! আমাদের দেশেও তাই।
আমরা বেশিরভাগ ই এই মুহুর্তে সুন্দরবন ১৬ লঞ্চের নিচতালায় থাকা ডেকের যাত্রী। কোনমতে গন্তব্যে ভেসে যাচ্ছি। তবে আমরা গর্বিত কারন আমরা সুন্দরবন ১৬ এর মতো ব্যায়বহুল, বিত্তশালী, বিলাসী রাষ্ট্রের যাত্রী। আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরাচ্ছে, ফুরাক! আমরা একটি আধুনিক লঞ্চে ভাসছি।আমাদের দেশ অন্যান্য বড়-বড় দেশের কাছে রপ্তানি বাজার হচ্ছে, হোক! আমরা একটি বিলাসবহুল লঞ্চের যাত্রী।
আমাদের শিক্ষা, চাকরি,কর্মসংস্থান সবকিছু ভোগের জন্য বরাদ্দ থাকছে কিছু নির্দিষ্ট প্রিমিয়াম ভিআইপি কেবিনের যাত্রীর কাছে। থাকুক! আমরা একটি অত্যাধুনিক লঞ্চের যাত্রী। লঞ্চের ডিলাক্স কেবিনগুলো বরাদ্দ রয়েছে বৃহৎ রুমে বসে থাকা আমলা, সিন্ডিকেট, বিগ-বিজনেস রোল প্লেয়ারদের জন্য। থাকুক।
তেলবাজ, চাটুকার, উচ্চমর্গীয় চাকরীওয়ালা, নানাবিধ কোম্পানি, বেশিপানির সিইইইইও, সহমত ভাইব্রো সবাই মিলেমিশে ভাগ করে নিয়েছে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ফ্যামিলি কেবিন। নিক!
উচ্চ বেতনভুক্ত সরকারি, বেসরকারি, বৃহৎ ও আধা বৃহৎ ব্যবাসায়ী,বাড়ীওয়ালা,প্রবাসী, জন্মসূত্রে ধনী পরিবারের সন্তান,সেলিব্রেটী ও ব্লগার শ্রেণীরা মিলেঝিলে আধাআধি চোখ বুজে জায়গা খুঁজে পেয়েছে যথাক্রমে ডাবল কেবিন, সিংগেল কেবিন ও সোফা সার্ভিসের। ওরাও নিক।সমস্যা নেই।
আমরা ডেকের যাত্রী। গন্তব্যে পৌছাতে পারলেই হোলো। তবে ডেকের যাত্রী হলেও আমাদের অবশ্য একটা লেভেল আছে। এই যে প্রচণ্ড কনকনে শীতেও আমাদের গায়ে গরম কাপড় আছে,আমাদের লেপ, কম্বল, কাথাঁ কাপড়ের অভাব নেই।
আমাদের পাশেই আরো কিছু ডেকযাত্রী আছে ওরা একদম জানালা বরাবর ত্যারাব্যাকা হয়ে শোয়া,ওদের গায়ে আবার শীতের কাপড়টুকুও নাই। ওরাও যাত্রী। তবে আমাদের চেয়ে সামান্য নিম্নশ্রেণীর আর কি।
আমরা একটু ডেকের মাঝামাঝি জায়গায় প্রচুর আতিথেয় পরায়ণ মনোভাব নিয়ে বসে আছি। প্রচুর কাগজপত্র সাথে নিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছি ভেসেভেসে। স্বপ্নগুলো সমস্ত মস্তিস্কের দীর্ঘশ্বাসে চেপে ছাই হচ্ছে, হোক। নুন আনতে পান্তা ফুরাচ্ছে ফুরাক! আমরা একটি আধুনিক সমুদ্রগামী সুবিশাল জাহাজের আদলে তৈরি “বাংলাদেশ” নামক লঞ্চের যাত্রী।
লেখিকাঃ ফায়াজুন্নেসা চৌধুরী, শিক্ষক, পিএইচডি রিসার্চার, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি নিয়মিত লেখালেখি করেন। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় তার লেখা বিশেষ আবেদন সৃষ্টি করে আসছে।
কিউএনবি/নাহিদা। ২১.০১.২০২৪/সকাল ৮.৩০