খোরশেদ আলম বাবুল শরীয়তপুর প্রতিনিধি : শরীয়তপুর সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে একটি দলিলের তল্লাশি ফি ২০ টাকার স্থলে ৫০০ টাকা নেওয়া হয়। এখানে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নাই। আরো চমক রয়েছে সামনে। দলিলের নকল বাবদ ৪৪৫ টাকা খরচের হিসাব প্রদান করে গ্রহণ করছেন ৩ হাজার টাকা। এসব সাব-রেজিস্ট্রার মুহাঃ জাহাঙ্গীর আলমের সামনে বসে প্রকাশ্যেই করেন নকল নবিশরা। এছাড়াও রয়েছে অবাক হওয়ার অনেক বিষয়। যেমন একটি দলিল রেজিস্ট্রেশন করার সকল বৈধ প্রক্রিয়া সমাপ্ত করে সাব-রেজিস্ট্রারের সামনে উত্থাপন করা হয়। সাব-রেজিস্ট্রারের ব্যক্তিগত সহকারী সোহেল দলিলটির চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন।
কোন প্রকার খুত পেলেই সাইড করে রাখা হয় দলিলটি। দলিল লিখককে ডেকে দেওয়া হয় দুইটি অপশন। প্রথম অপশনে রাজি থাকলে দলিল লেখককে সাব-রেজিষ্ট্রারের খাস কামরায় ডেকে নিয়ে চলে দরদাম। দরদামে বনিবনা হলে দলিল রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়। অন্যথায় দলিলটি ফেরৎ নিতে হয়। সাব রেজিস্ট্রার দলিলে সাক্ষর করলে দলিলটি চলে যায় ভিন্ন একটি টেবিলে। সেখানে রয়েছে দেলোয়ার নামে একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। তিনি দাতার টিপসহি গ্রহণ করেন।
দাতার সংখ্যা ১ জন হলে তিনি ৫০০ টাকা গ্রহন করে খুশি থাকেন। দাতার সংখ্যা যদি একাধিক হয় আর দলিলটি যদি উচ্চ মূল্যের হয় তাহলে সেই চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীকে খুশি করতে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত লাগে। চাহিদা পূরণ না হলে টাকা ছুড়ে ফেলা হয় বিক্রেতার দিকে। এসবই ঘটে সাব-রেজিষ্টারের চোখের সামনে। দলিল লেখকদের কেউ প্রতিবাদ করলে বিনা নোটিশে সাজা ভোগ করতে হয় তাদের। এই জন্যই জবাবদীহিতা ছাড়া চলছে শরীয়তপুর সদর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস।
দলিলের সার্টিফাই নকল প্রত্যাশী এক ব্যক্তি গত ২২ অক্টোবর সদর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে যায়। প্রথমে তিনি সাব-রেজিস্ট্রারের প্রধান সহকারী আক্তার হোসেনের সাথে দেখা করে দলিলের নকল পেতে চায়। তখন আক্তার হোসেন মলি নামে এক স্টাফকে ডেকে নকলের বিষয়ে নকল প্রত্যাশী ব্যক্তিকে সহায়তা করতে বলেন। মলি ওই ব্যক্তিকে নিয়ে যায় ইয়াসমিন আক্তার নামে আরেক মহিলা স্টাফের কাছে। নকল প্রত্যাশী ব্যক্তি ইয়াসমিনকে জানায় ২০১৯ সনের মে মাসের পরে দলিলটি রেজিস্ট্রি হয়েছে। তখন ইয়াসমিন দলিল তল্লাশির জন্য ৫০০ টাকা দাবী করেন। কিছু টাকা কম দিতে চাইলে ইয়াসমিন রাজী হয় না।
তখন ৫০০ টাকা দিয়েই দলিল তল্লাশি করায় সেই ব্যক্তি। কিছুক্ষণ তাকে বসিয়ে রেখে ইয়াসমিন জানায় দলিল পাওয়া গেছে। এখন কি নকল নিবেন? সাধারণ নকল ২০ দিনে ডেলিভারীতে ২ হাজার ৫০০ টাকা আর জরুরী নিলে ১ দিনে ডেলিভারী ৩ হাজার টাকা লাগবে। তখন নকল প্রত্যাশী বাধ্য হয়ে ৩ হাজার টাকার বিনিময়ে জরুরী ভিত্তিতে নকল নিতে রাজি হয়। তবে ১ হাজার টাকা অগ্রিম পরিশোধ করে অবশিষ্ট ২ হাজার টাকা নকল গ্রহণের সময় পরিশোধের দাবী জানায়। ইয়াসমিন নকল গ্রহীতার দাবী প্রত্যাখান করে সমুদয় টাকা অগ্রিম দাবী করে। ওই ব্যক্তি টাকা পরিশোধ করায় সময়মত দলিলের নকল পেয়ে খুশি হয়েছেন।
তবে ওই ব্যক্তির মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে দলিলের নকল পেতে সরকারী খরচ কত? পরবর্তী কার্যদিবসে তিনি জেলা রেজিস্ট্রার অফিসে গিয়ে ৮ পাতার একটি দলিলের নকল পেতে কত খরচ লাগে তা জানতে চায়। তখন সেখানে দায়িত্বরত রেকর্ডকিপার ওয়াহিদুজ্জামান জানায় জরুরি ভিত্তিতে ৮ পাতা বিশিষ্ট একটি দলিলের নকল পেতে ৬৮১ টাকা লাগে। এরমধ্যে তল্লাশী ফি মাত্র ২০ টাকা। অথচ তার কাছ থেকে তল্লাশী ফি গ্রহণ করেছেন ৫০০ টাকা। আর তল্লাশী ফি বাদে নকল বাবদ লেগেছে ৬৬১ টাকা। সেক্ষেতেও নেওয়া হয়েছে ৩ হাজার টাকা। তল্লাশি ফি সহ দলিলের নকল পেতে লেগেছে ৩ হাজার ৫০০ টাকা।
কেন এত বেশী টাকা নেওয়া হয়েছে তা জানতে তিনি দেখা করেছিলেন সদর সাব-রেজিস্ট্রার মুহাঃ জাহাঙ্গীর আলমের সাথে। সেখানে প্রধান সহকারী আক্তার হোসেন ও দলিল লিখক সমিতির সভাপতি আলহাজ্ব নুরুল হক মিয়ার উপস্থিতিতে সাব-রেজিস্ট্রারের কাছে নকল গ্রহীতা জানতে চান কেন তার কাছ থেকে অনেকগুন বেশি ফি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রশ্ন অনুযায়ী কোন উত্তর না দিয়ে নকল গ্রহীতার কাছ থেকে আদায়কৃত অতিরিক্ত টাকা ফেরৎ দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেন সাব-রেজিস্ট্রার। দলিল গ্রহীতা ফেরৎ দিতে চাওয়া টাকা গ্রহণ করেননি।
তিনি আরো জানান, আমার শুধু জানা প্রয়োজন ছিল দলিলের নকল পেতে খরচ কত আর আমাদের কাছ থেকে কতগুন টাকা বেশী আদায় করা হয়। টাকা ফেরৎ নেওয়া তার মূল উদ্দেশ্য ছিল না। এই বিষয় নিয়ে তিনি একাধিক দলিল লিখক ও ভুক্তভোগীদের সাথে আলাপ করে জানতে পেরেছেন। সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিস সকলকে জিম্মি করে রেখেছে। সাব-রেজিস্ট্রারসহ তার অধিনস্ত সকলের দাবী পূরণ না করলে কেহই রক্ষা পায় না।
তিনি আক্ষেপ করে জানান, আবু আলম নামে একজন দলিল লিখক রয়েছে। সে এডভোকেট হেলাল উদ্দিন আকন্দের একটি পারিবারিক দলিল লিখেছিলেন। সেই দলিল নিয়ে সাব-রেজিস্ট্রারের সাথে এডভোকেটের কথা কাটাকাটি হয়। বিষয়টি কোন একটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। সেই থেকে দলিল লিখক আবু আলেমের কোন দলিল নেওয়া হয় না। তাকে শর্ত জুড়ে দিয়েছে যদি সংবাদ মাধ্যম থেকে প্রকাশিত সংবাদ মুছে দেওয়া হয় তাহলে আবু আলেমের দলিল গ্রহণ করা হবে। এমনি ভাবে ৩ মাস অতিবাহিত হতে চলছে।
সকল বিষয়ে অবগত হয়ে কতিপয় দলিল লিখকদের সাথে কথা বলে সত্যতা মিলেছে। তারা জানায় কাগজের ত্রুটির জন্য যে দলিল ফেরৎ দেওয়া হয় সেই দলিল টাকার বিনিময়ে কি ভাবে হতে পারে। দলিলের নকল পেতে তাদেরও আরো বেশী হয়রানী হতে হয়। কোন আম মোক্তার-নামা দলিল দ্বারা কোন সাব-কবলা দলিল রেজিস্ট্রি হলে সাব-রেজিস্ট্রারকে লাখ প্রতি বাধ্যতামূলক তাকে ১ হাজার টাকা করে অতিরিক্ত প্রদান করতে হয়। কোন দলিল লিখক এই টাকা পরিশোধ না করলে পরবর্তী যে কোন দলিলের জন্য তাকে নানান প্রকার হয়রানী হতে হয়।
সূত্রটি আরো জানায়, দলিল দাতাগণ নামের কোন ত্রুটি স্থানীয় চেয়ারম্যান প্রত্যয়ন করলে বা প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক এফিডেভিট করা থাকলেও সাব-রেজিস্ট্রারকে ২ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত প্রদান করতে হয়। তা না হলে সেই দলিলটি একাধিকবার ফেরৎ দেওয়ার নজির রয়েছে এই অফিসে। এছাড়াও বিভিন্ন নতুন উপায়ে হয়রানী হতে হয় দলিল লিখক, দলিল দাতা-গ্রহীতা ও দলিলের সার্টিফাইড নকল প্রত্যাশীদের।
এসকল বিষয়ে কথা হয় দলিল লিখক সমিতির সভাপতি নুরুল হক মিয়ার সাথে। তিনি জানায়, দলিল লিখক আবু আলেম এডভোকেট হেলাল উদ্দিন আকন্দের একটি দলিল লিখেছিল। সেখানে সাব -রেজিস্ট্রারের সাথে হেলাল উদ্দিনের বিতর্ক হয়। সেই থেকে আবু আলেমের আর কোন দলিল গ্রহণ করেনি সাব-রেজিস্ট্রার। আমরা সাব-রেজিস্ট্রারের সাথে বসে একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম। যেন ১ মাস পরে তার দলিল গ্রহণ করা হয়। প্রায় তিন মাস অতিবাহিত হতে চলছে তবুও আবু আলেমের কোন দলিল নেওয়া হয় না। আমাদের হাতপ-পাঁ বাধা। সব কথা বলতে পারি না।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় সদর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার মুহাঃ জাহাঙ্গীর আলমের সাথে, তিনি জানায়, নকল নবিশরা কোন বেতন পায় না তাই অতিরিক্ত টাকা নেয়। দলিলের সার্টিফাইড নকল গ্রহীতার কাছ থেকে যে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে তা ফেরৎ দেওয়ার জন্য বলেছেন। তবে অন্যান্য কোন বিষয়ে সে কথা বলতে রাজি হয়নি।
কিউএনবি/আয়শা/০৮ নভেম্বর ২০২৩,/বিকাল ৪:৩৩