মোসাদঃ ইসরায়েলের দুর্ধর্ষ এক গোয়েন্দা সংস্থা
———————————————————
আজ থেকে ৫০ বছর আগে ইসরাইলের ওপর আকস্মিক আক্রমণ চালিয়েছিল মিসর ও সিরিয়া। যা ইওম কিপুর যুদ্ধ নামে পরিচিতি পায়। এবারে একই উপায়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলের ওপর বড় ধরনের আক্রমণ শুরু করেছে। হামাসের এ হামলায় এখন পর্যন্ত ৬০০ ইসরাইলি নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে নিহত ৪৪ জন সেনা সদস্যের পরিচয় প্রকাশ করেছে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ।
ইসরাইল-গাজা বেড়া থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার ভিতরে দক্ষিণ ইসরাইল থেকে আলজাজিরার প্রতিনিধি জানিয়েছেন, দক্ষিণ ইসরাইলের অনেক শহর ও গ্রাম থেকে সেখানে অবস্থান নেয়া হামাস যোদ্ধাদের এখনো প্রতিহত করতে পারছে না ইসরাইলি বাহিনী। কিন্তু কথা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ও চৌকষ গোয়েন্দা সংস্থা হলো ইসরাইলের মোসাদ। এই গোয়েন্দা সংস্থাকে ফাঁকি দিয়ে হামাসের ইসরাইলে প্রবেশ করে যুদ্ধ করা এক অবিশ্বাস্য কাহিনী। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা মোসাদ সম্পর্কে কিছু তথ্য ও ইতিহাস জেনে নিতে পারি। কি হল বর্তমান মোসাদের ?
আরব লীগের প্রত্যাখানের মুখে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে দখলভূমিতে ইসরাইলকে ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। ইউরোপে ইহুদী নিধনযজ্ঞ বা ‘শোয়া’র দুঃস্বপ্ন ভুলতে পারে নি সেদেশের মানুষ৷ ফলে আরও একবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দূর করতে যে কোন পদক্ষেপ নিতে শুরু থেকেই প্রস্তুত ছোট্ট এই ইহুদী রাষ্ট্র৷
রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার ১৯ মাসের মাথায় দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডাভিড বেন গুরিয়ন ‘মোসাদ’ প্রতিষ্ঠা করেন। ডিসেম্বর ১৩, ১৯৪৯ সালে দ্য সেন্ট্রাল ইন্সিটিটিউট ফর করডিনেসন নামে মোসাদের কর্যক্রম শুরু হয় তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫১ সালের মার্চে। ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার আগেই যেসব ইহুদি নিষিদ্ধ সংগঠন সংগ্রাম চালাচ্ছিল, তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতে যে কাঠামো গড়ে উঠেছিল, তাকে ‘মোসাদ’ এর পূর্বসূরি বলা হয়। মোসাদ সামরিক সার্ভিস নয়। যওি অধিকাংশ কর্মকর্তাই ইসরাইলের ডিফেন্স ফোর্সের।
১৯৪৯ সালে মোসাদের জন্ম হলেও ১৯৯৬ পর্যন্ত কেউই জানতো না এই সংস্থাটার প্রধানের কথা। ১৯৯৬ সালে যখন সাবতাই কে অপসারন করে ডেনি ইয়াতমকে নিয়োগ দেওয়া হয় এক ঘোষণার মাধ্যমে, তখন প্রথমবারের মত বিশ্ববাসী জানতে পারে এই সংস্হাটার প্রধান কে। ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে ২৮তম কম্যুনিস্ট সম্মেলনে যখন নিকিটা ক্রুশ্চেভ এক গোপন মিটিংয়ে ‘স্টালিনকে’ অভিযুক্ত ও অস্বীকার করে নিজেই প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা করে। ঐ বক্তব্যের এক কপি মোসাদ সিআইএর হাতে দিয়ে দেয়। এই প্রথম সিআইএ মোসাদের কার্যক্রম উপলব্ধি করে যাতে সিআইএ অভিভূত হয়। কারণ সিআইএর মত সংস্থাটিও এই রকম একটা স্পর্শকাতর সংবাদ সংগ্রহে ব্যর্থ হয়েছিল।
মোসাদ ইসরায়েলের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা। আমান (সামরিক গোয়েন্দা) ও শিন বেতের (অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা) পাশাপাশি এটি ইসরায়েলি গোয়েন্দা সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান সংগঠন। মোসাদ গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, গোপন অভিযান ও সন্ত্রাসবাদ দমনে কাজ করে। এর পরিচালক সরাসরি এবং শুধু প্রধানমন্ত্রীর কাছে জবাবদিহি করেন। এর বার্ষিক বাজেট আনুমানিক প্রায় ১০ বিলিয়ন শেকেল ($২.৭৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) এবং অনুমান করা হয় যে, এটি প্রায় ৭,০০০ লোককে সরাসরি নিয়োগ করে। এটি বিশ্বের বৃহত্তম গুপ্তচরবৃত্তি সংস্থাগুলির মধ্যে অন্যতম। মোসাদ অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থা, যেমন: ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী বা ইসরায়েল নিরাপত্তা সংস্থা থেকে ভিন্ন, কেননা এর উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, ভূমিকা, কার্যভার, ক্ষমতা বা বাজেট কোনো আইন দ্বারা সংজ্ঞায়িত নয়।
মোসাদের কাজের রিপোর্ট ও গোয়েন্দা তথ্য সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে দিতে হয়। এর নীতিমালা ও কার্যক্রম অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ, যুক্তরাজ্যের এমআই৬ ও কানাডার সিএসআইএস এর অনুরূপ। মোসাদের হেডকোয়ার্টার তেলআবিবে। ইসরাইলের সীমানার বাইরে গোপনে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা, শত্রুভাবাপন্ন দেশগুলি যাতে বিশেষ ধরনের অস্ত্র তৈরি বা সংগ্রহ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করা এবং দেশে-বিদেশে ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুর উপর হামলার ষড়যন্ত্র আগাম প্রতিরোধ করা, যেসব দেশে ইসরায়েলের অভিবাসন সংস্থা আইনত সক্রিয় হতে পারে না, সেই সব দেশ থেকে ইহুদিদের ইসরায়েলে নিয়ে আসার দায়িত্ব পালন করে ‘মোসাদ’।
ইসরায়েলি সামরিক ও অসামরিক গোয়েন্দা বিভাগের বাছাই করা কর্মকর্তাদের দিয়ে পরিচালিত মোসাদের মোট আটটি বিভাগ রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি ডিপার্টমেন্টের কিছু তথ্য জানা যায় : কালেকশন ডিপার্টমেন্ট: এটি মোসাদের সবচেয়ে বড় বিভাগ। বহির্বিশ্বে ডিপ্লোম্যাট, ব্যবসায়ী, সাংবাদিকসহ অন্যান্য ছদ্মবেশে কাজ করেন এই বিভাগের এজেন্টরা।
পলিটিক্যাল অ্যাকশন এবং লিয়াজোঁ ডিপার্টমেন্ট: এ গ্রুপের কাজ প্রতিটি বন্ধুভাবাপন্ন দেশের গোয়েন্দা ও গুপ্তচর সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করা।
স্পেশাল অপারেশন ডিপার্টমেন্ট: এই গ্রুপকে গুপ্তহত্যার কাজে ব্যবহার করা হয়।
ল্যাপ ডিপার্টমেন্ট: এই গ্রুপ প্রতিপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে মনস্তাত্তি্বক যুদ্ধের জন্য প্রচার চালায় ও শত্রু শিবিরে ভুল খবর ছড়িয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করে।
রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট: যাবতীয় গোয়েন্দা গবেষণা ও ‘কাউন্টার ইনটেলিজেন্স’-এর ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বৃদ্ধির নিরন্তর কাজ করে চলেন এই গ্রুপের গবেষকরা
ডেভিড বার্নে : ২০২১ সাল – বর্তমান পর্যন্ত মোসাদ এর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।দুর্ভাগ্য ডেভিড বার্নের, তার সময়কালে হামাস ও হিজবুল্লাহ এর কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে গেল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এক গোয়েন্দা সংস্থা। ইতিহাসে যাদের দুর্ধর্ষ ও চৌকষতার কাহিনী ছিল শরীরের লোম শিউরে উঠার মত।
লেখকঃ লুৎফর রহমান একজন রাজনীতিবিদ ও লেখক। তিনি নিয়মিত লেখালেখির পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক নিউজ মিডিয়ার সম্পাদক ও প্রকাশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র লুৎফর রহমান ৮০ এর দশকের স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরতে দুটি রাজনৈতিক উপন্যাস লিখেছেন, যা দেশ বিদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় জীবনের খন্ডচিত্র এঁকে তিনি এখন ব্যাপক পরিচিত।
কিউএনবি/ বিপুল/ ০৮.১০.২০২৩/ সন্ধ্যা ৭.৫৫