সম্পর্ক
——–
আমার আম্মি (শাশুড়ি), প্রথম আমি উনাকে যখন দেখি, মনে মনে ভেবেছি এই বয়সে এসেও মানুষ এতো সুন্দর হয় কি করে! অনেকক্ষণ উনার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম মুগ্ধ হয়ে!
আম্মি পুরান ঢাকার মেয়ে, উর্দুভাষী, কিন্তু আমার সাথে সম্পূর্ণ শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতেন। যদিও বলতে কষ্ট হতো তবুও বলতেন। মাঝে মাঝে বাংলায় শুরু করে উর্দুতে শেষ করতেন। আমার ভীষন মজা লাগতো আম্মির কথা শুনতে।
শিখেছি উনার কাছ থেকে সাংসারিক অনেক কিছু। উনার প্রতিটা কাজ ছিল নিখুঁত। তরকারি কাটা থেকে নিয়ে শুরু করে কাপড় ভাঁজ, দেখলে শুধু দেখতেই ইচ্ছা হতো।
আমার বিয়ের পর তিনি হয়েছিলেন আমার বান্ধবীর মতো। আম্মির জীবনের বিয়ে থেকে শুরু করে সুখ দুঃখের সব কথা আমার সাথে বলতেন। আম্মির বিয়ে হয়েছিল তার খালাতো ভাইয়ের সাথে। যখন আম্মির গল্প গুলো শুনতাম, মনে হতো আমি সেই জীবনটা ঘুরে দেখে এলাম।
একবার আম্মি গল্প করছিলেন, আগের দিনে ছোট ছোট বাচ্চা থাকা অবস্থাতেও কিভাবে ঘরের কাজ শেষ করতেন -“আমাদের একটা অনেক বড় সিন্দুক ছিল। এত বড় ছিল যে পাঁচ ছয় জন অনায়াসে ঢুকতে পারতো। যৌথ পরিবার, বাসায় অনেক গুলো ছোট ছোট বাচ্চা কাচ্চা ছিল। সকালে নাস্তার পর আমার শাশুড়ি ছোট ছোট বাচ্চা গুলোকে আফিম চাটিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। আর সেই সুযোগে আমরা ঘরের সব কাজ শেষ করে ফেলতাম। রান্না বান্না, ঘর গুছানো, কাপড় ধোয়া, গোসল সব।”
প্রথমে শুনে অনেক হেসেছি, আবার খুব মায়াও হয়েছে মা আর বাচ্চা গুলোর জন্য। আম্মির কাছে অনেক রান্না শিখেছি, যে রান্না গুলো পুরান ঢাকার ঐতিহ্য। যেমন – টেক্কা, কোরমা, ছেচকি, গুটলি শুটকি, সাজনা শুটকি বায়গান(বেগুন) আরো অনেক অনেক কিছু। যে রান্না গুলো শুধু পুরান ঢাকাতেই হয়ে থাকে।
চেষ্টা করি এখনো মাঝে মাঝে সেই রান্না গুলো রাধতে, যদিও রান্নার প্রসেসিং গুলো সাধারণ থেকে অনেক ভিন্ন। হয়তো আমার সংসারে আমার পর এই রান্না বিলুপ্তই হয়ে যাবে। কারণ ইউটিউব এ ও এই পুরান ঢাকার রান্নার রেসিপি নেই। আম্মি দেশ বিদেশ ঘুরতে খুব পছন্দ করেন। ক্যানাডা সহ অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন তিনি।
একবার বলছেন – “অনেক দেশ আল্লাহ্ পাক দেখিয়েছেন, এখন মনে একটা ইচ্ছা, যদি সিঙ্গাপুর টা দেখতে পারটাম!” দুষ্টুমি করে বলেছিলাম “আম্মি সিঙ্গাপুর গেলে আপনাকে প্যান্ট শার্ট পরতে হবে!” তিনি হেসে বলেছিলেন “কয়েকদিন না হয় পড়লাম কষ্ট করে যে কয়দিন সিঙ্গাপুর থাকবো” দুর্ভাগ্য বশত আম্মির এখনো সিঙ্গাপুর দেখা হয়নি।
আরেকটা মজার ঘটনা! আমার বিয়ের পর পর দেখতাম প্রতিদিন সকালে আম্মি আমার শ্বশুর আব্বা বিছানায় থাকা অবস্থাতে তার পা টিপতেন, আর খুব মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতেন আব্বার সাথে। মনে মনে ভাবতাম “আহা… এখনো কি প্রেম দুজনার”। সব সময় তার কিছুক্ষণ পর গিয়েই আম্মি আব্বার ঝুলিয়ে রাখা শার্ট/পাঞ্জাবি নেড়ে চেড়ে দেখতেন।
আমার কাছে রহস্যের মত মনে হতো! মনে প্রশ্ন জাগতো কেনো আম্মি প্রতিদিন একই জিনিষ করছেন? অনেক দিন পর রহস্য উদঘাটন হলো! আব্বার পা টিপে দেয়ার পর আম্মি যত টাকাই চাইতেন আব্বার কাছে, আব্বা খুশি মনে বলতেন নিজের হাতে বের করে নাও। তাই আম্মি আব্বার কাপড় গুলো নারা চারা করতেন।
আমিতো ট্রিক শিখে ভীষন খুশী! ভাবলাম বংশ পরম্পরা হিসেবে আমিও কিছু পাবো তার ছেলের কাছ থেকে! দুঃখের বিষয় আমি উনার ছেলের পা টিপলে টাকা তো দূরের কথা, এক পয়সাও বের হয় না! তাই পা ও টিপি না।
এবার ১০ বছর পর আম্মি ক্যানাডা থেকে বাংলাদেশ গিয়েছেন। বাথরুমে পড়ে গিয়ে পায়ের হার ভেঙে বিছানায় পড়ে আছেন। হৃদরোগী হওয়ার কারণে এখন আরো অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে।উনি এখন হসপিটালে ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে আছেন। উনার সুস্থতা কামনা করে সবার কাছে দোয়া প্রার্থী।
লেখিকাঃ রুপা মোজাম্মেল লেখাপড়া শেষ করে কানাডায় বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কোর্স শেষ করেছেন। সেখানেই তাঁর কর্ম জীবন। লেখালেখি করেন নিয়মিত। জীবনের খন্ডচিত্র আঁকতে পারদর্শিনী রুপা মোজাম্মেল।
কিউএনবি/বিপুল/০৫.০৮.২০২২/ রাত ১১.১০