ডেক্সনিউজঃ ‘প্রতি তিন মাস পরপর ১২০০ টাকা পাই। কিন্তু, এই টাকা দিয়া তো কিছুই হয় না মা। ডাক্তারের ফি দিতে আর ওষুধ কিনতেই সব টাকা শেষ হইয়া যায়।’
কথাগুলো বলছিলেন ভানুমতি। বয়স আনুমানিক ৭৫ বছর। অনুমান করেছি এই কারণে যে নিজের বয়সটা তিনি বলতে পারেননি।
ভানুমতির দেখা পাই ২৮ ডিসেম্বর ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার কলাতিয়া ইউনিয়নের আলিনগর গ্রামে। পাশের আহাদিপুর গ্রামে তাঁর বসবাস। স্বামী মারা গেছেন বহু বছর আগে।
তিন মাস পরপর যে ১ হাজার ২০০ টাকা পাওয়ার কথা বলছিলেন ভানুমতি, তা হচ্ছে সরকারের কাছ থেকে পাওয়া বয়স্ক ভাতা। ভানুমতি জানান, তিনি মাসে ৪০০ টাকা করে বয়স্ক ভাতা পান। কিন্তু তিন মাস পরপর তোলার নিয়ম। তিন মাসে ১ হাজার ২০০ টাকা পান। আগে পেতেন মাসে ৩০০ টাকা করে।
দেশের বয়োজ্যেষ্ঠ দুস্থ ও স্বল্প উপার্জনক্ষম অথবা উপার্জনে অক্ষম বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে ও পরিবার ও সমাজে মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে ‘বয়স্ক ভাতা’ কর্মসূচি প্রবর্তন করা হয়। প্রাথমিকভাবে দেশের সব ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিটি ওয়ার্ডে ৫ জন পুরুষ ও ৫ জন নারীসহ ১০ জন দরিদ্র বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে প্রতি মাসে ১০০ টাকা হারে ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তী সময়ে দেশের সব পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনকে এ কর্মসূচির আওতাভুক্ত করা হয় এবং টাকার পরিমাণও বাড়ানো হয়।
এই বয়স্ক ভাতা দেওয়া নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা অভিযোগও পাওয়া গেছে। যেমন বয়স্ক না হওয়ার পরও স্থানীয় ইউপি সদস্যের আত্মীয় হওয়ায় এক ব্যক্তি পেয়েছেন বয়স্ক ভাতা। প্রকৃত দুস্থ বয়স্করা ভাতা পাচ্ছেন না। দেশের কোনো কোনো স্থানে টাকা ছাড়া মেলে না বয়স্ক ভাতার কার্ড। প্রতিটি বয়স্ক ভাতার কার্ড নিতে গুনতে হয় ছয়-আট হাজার টাকা। কোথাওবা আবার বয়স্ক ভাতা তুলতে গিয়ে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অসৌজন্যমূলক আচরণের শিকার হন গ্রহীতারা। কোনো কোনো ব্যাংক বয়স্ক ভাতার টাকা আত্মসাৎ করেছে, এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে। যাহোক বয়স্ক ভাতা পান এ রকম একজন বৃদ্ধার সন্ধান পেয়ে কেরানীগঞ্জ যাই। পরিচয় হয় ভানুমতির সঙ্গে।
শীতের সকালে গায়ে একটি চাদর জড়িয়ে জবুথবু হয়ে বসে ছিলেন আলিনগর গ্রামের একটি বাড়ির আঙিনায়। একটু দূরেই তাঁর নিজের বাড়ি। রোদ পোহাতে প্রায়ই আসেন এখানে।
জিজ্ঞেস করি, কবে থেকে এই বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন?
ভানুমতির উত্তর, ‘এই পাঁচ-ছয় বছর ধরি টাকাটা পাই। কিন্তু মা, আমার এত অসুখ। ওষুধ কিনতে এক মাসেই এই চেইয়া বেশি টাকা লাগে।’
মাসে কত টাকার ওষুধ কিনতে হয়?
‘এই ধরেন তিন হাজার টাকা।’
তো বাকি টাকা কীভাবে জোগাড় করেন?
‘জোগাড় হয় না মা। মাঝেমইধ্যে লোকজনের কাছ থেইক্যা কর্জ করি। কিন্তু শোধ তো দিবার পারি না। তখন মাইনষের অনেক কথা শুনন লাগে। এখন আর মাইনষে কর্জও দিতে চায় না।’
আপনি থাকেন কার কাছে? বাড়িতে আর কে কে আছে?
‘আমি আমার ছেলের কাছে থাকি।’
ছেলে কী কাজ করেন?
‘কী আর করবে? পড়ালেখা করাইতে পারি নাই। ছেলে আমার কামার। দা-বঁটি বানায়।’
ছেলের রোজগার মাসে কেমন?
‘কেমন আর, এই কখনো চাইর হাজার, কখনো পাঁচ হাজার। এর বেশি হয় না। কিন্তু এই টাকা দিয়া তো মা সংসারই চলতে চায় না। আমারে আলাদা কইরা ওষুধ কিনা দিব কেমনে?’
আপনার অসুখটা কী?
‘লিভারের অসুখ মা। নিয়ম কইরা ওষুধ খাওনের কথা। কিন্তু টাকার অভাবে ওষুধ কিনতে পারি না। তাই অসুখও ভালা হয় না।’
আপনার কি এই এক ছেলেই? আর ছেলেমেয়ে নেই?
‘আমার দুই ছেলে, দুই মেয়ে। থাকি ছোট ছেলের কাছে।’
বাকি ছেলেমেয়েরা আপনাকে দেখে না?
‘বড় ছেলের অসুখ। কোনো কাম তো করবার পারে না। রোজগারই নাই। হে আমারে দেখব কী। ছেলের ঘরে দুইটা নাতি আছে, তারা যা আয়-রোজগার করে তা দিয়া বড় ছেলের সংসার কোনো রকম চলে। আর মেয়ে দুইটার তো মা বিয়া দিয়া দিছি। তারা তাগো সংসার নিয়া আছে। ছমাসে-নমাসে এক-দুই শ টাকা দেয়। হেই দিয়া কি আর কিছু হয়। কিছু হয় না।’
ব্যাংক থেকে টাকা তোলার সময় কোনো ঝামেলা বা অসুবিধা হয়?
‘না, কোনো অসুবিধা হয় না।’
এরপর ভানুমতি গায়ের চাদর সরিয়ে ডান হাতটা দেখান। দেখলাম প্লাস্টার করা। জানতে চাই কী করে তিনি হাত ভাঙলেন। ভানুমতি বলেন, কদিন আগে সোনালী ব্যাংক থেকে বয়স্ক ভাতার টাকা তুলে তিনি হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন। এমন সময় একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা তাঁকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। পড়ে গিয়ে তাঁর ডান হাতটি ভেঙে যায়। হাতের চিকিৎসা করাতে গিয়ে এরই মধ্যে ব্যয় হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। ধার করে ভানুমতিকে এই খরচ মেটাতে হয়েছে। এই ধার তিনি কীভাবে শোধ দেবেন জানেন না।
এরপর ভানুমতি আমার কাছে জানতে চান, ‘কিন্তু মা আপনি আমার কাছে এত কথা জানতে চাইতাছেন কেন?’ নিজের পরিচয় দেওয়ার পর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ভানুমতির।
বলেন, ‘ও পেপারে কাজ করেন? তাহলে আপনার পেপারে একটু লেইখা দেন না যে আমাগো মতো বুড়াদের সরকার যেন আরও একটু বেশি টাকা দেয়। আমরা তো সরকাররে অনেক দোয়া করি। সরকার যদি চিকিৎসার লেইগা আলাদা কইরা কিছু টাকা দিত তাহলে খুব ভালা হইত। মা, আপনারে কী বলব, আমার অনেক কষ্ট।’
কুইকনিউজবিডি.কম/ মাখলুকাত / ৩১শে ডিসেম্বর, ২০১৬ ইং / সকাল ১০:০৯